গুমোট বাঁধা নিস্তব্ধতা। ঘন গাছপালা। ঠিকমত পৌঁছাতে পারছে না সূর্যের আলোও। আবছা আলোতে নেই কোন জনমানব। গা ছমছমে ভাব। গভীরতা ক্রমশ যেন বেড়েই চলেছে। তীব্র হচ্ছে লাশের গন্ধ। হঠাৎই সামনে পড়ল ঝুলন্ত একটি মৃতদেহ।
মনে হচ্ছে এটা কোন হরর মুভি বা ভৌতিক উপন্যাসে ঘটে যাওয়া পরিচিত কোন দৃশ্য। কিন্তু শুধু হরর মুভি বা ভৌতিক উপন্যাস নয় বরং বাস্তবেই আপনি সম্মুখীন হতে পারেন এমন একটি দৃশ্যের। যদি এডভেঞ্চার ভালোবেসে থাকেন আর হতে চান এমনই গা শিউরে উঠা এক অভিজ্ঞতার সাক্ষী তাহলে অওকিগাহারা হচ্ছে আপনার জন্য সঠিক জায়গা। অওকিগাহারা জাপানের একটি রহস্যময় বন। এ বনে যারা আসেন তাদের উদ্দেশ্য পুরোপুরিই ভিন্ন। পর্যটক বা ভ্রমণকারী নয়, বরং আত্মহত্যাকারী হতেই এ বনের পথে পা বাড়ান অসংখ্য মানুষ। আর তাই সুইসাইড ফরেস্ট বা আত্মহত্যার বন বলে এর বিশেষ কুখ্যাতি রয়েছে। অওকিগাহারা বন সম্পর্কে জাপানিদের মধ্যে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। তারা বিশ্বাস করেন, এ বনের মধ্যে কেউ গেলে আর ফিরে আসে না। এধরণের কিছু ভয়ংকর তথ্যই অওকিগাহারাকে করে তুলেছে পৃথিবীর রহস্যময় স্থানগুলোর একটি। তো জেনে নেয়া যাক রহস্যে ঘেরা এই বন ও আত্মহত্যা সংক্রান্ত কিছু তথ্য।
১। ঘন গাছপালার কারণে গোলকধাঁধাময় এই বনটি এতই বিভ্রান্তিকর ও গোলমেলে যে অনেক মৃতদেহের সন্ধানই পাওয়া যায় না অনেক বছর। আবার অনেক মৃতদেহ অনাবিষ্কৃতই থেকে যায়। এই কারণে অওকিগাহারায় আত্মহত্যার সঠিক হার নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। তবে কিছু সমীক্ষা দাবী করে, প্রতি বছর একশ জনের মত লোক এখানে আত্মহত্যা করে।
২। অন্যান্য দেশে আত্মহত্যাকে অপরাধ বলে মনে করা হলেও জাপানের ঐতিহ্যে আত্মহত্যার প্রচলন ছিল। ফিউডাল এইজে জাপানে সামুরাই নীতিতে বিশ্বাসীরা ‘সেপুকু’ (আত্মহত্যায় মুক্তি) এর মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে যাওয়া যায় বলে ধারণা করত। এ ধরনের আত্মহত্যা কে জাপানি সমাজে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা হত। এখনো অনেক জাপানি এ নীতি বিশ্বাস করেন।
৩। জাপানিদের আত্মহত্যার সংখ্যাটি বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় জাপানে আত্মহত্যার হার ছিল লক্ষণীয়। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে মোট আত্মহত্যার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ২৬৪৫ জনে যা আগের বছরের তুলনায় ১৫% বেশি। এর সংখ্যা চূড়ান্ত পর্যায় আসে মার্চ মাসে জাপানের অর্থবছরের শেষে। দেখা গেছে মানসিক চাপ ও পারিবারিক সমস্যার কারণেই অধিকাংশ লোক আত্মহত্যা করে। এর পেছনের মূল কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক অবনতি, চাকরি হারানো বা বেকারত্বকেই দায়ী করা যায়। আত্মহত্যা ও ক্রেডিট পরামর্শদাতা টয়োকি ইয়োসিদা বলেন, “বেকারত্বই আত্মহত্যার মূল কারণ”।
৪। আত্মহত্যার হার কমানোর জন্য জাপান সরকার একটি আইন পাস করে। পরবর্তী সাত বছরের মধ্যে আত্মহত্যার হার ২০% কমিয়ে আনাই ছিল এর উদ্দেশ্য। এর দরুন সুইসাইড ফরেস্টের প্রবেশ পথে লাগানো হয় সিকিউরিটি ক্যামেরা, বাড়ানো হয় সতর্ক প্রহরা। বনের পথে জায়গায় জায়গায় সাইনবোর্ডের ব্যবস্থা করে সুইসাইড প্রিভেনশন অ্যাসোসিয়েশনগুলো। সাইনবোর্ডে লেখা হয় বিশেষ ম্যাসেজ ‘তোমার সন্তান ও পরিবারের কথা ভাবো’, ‘তোমার জীবন পিতা-মাতার কাছ থেকে মূল্যবান উপহার।’ ‘ দয়া করে আত্মহত্যা করার আগে পুলিশের পরামর্শ নাও।’
৫। আত্মহত্যার বিষয়টি বাদ দিলাম। তারপরেও অওকিগহারায় ভ্রমণের উপযোগী পরিবেশ রয়েছে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। গভীর ও সুবিশাল এ জংগলে একবার ঢুকলে বের হওয়ার রাস্তা পাওয়া খুব মুশকিল। অদ্ভুতরকমের মোচড়ানো ও বাঁকানো আকৃতির গাছগুলো যেন বনের রহস্য আরও বাড়িয়ে দেয়। গাছের শিকড়গুলো জালের মত আঁকড়ে রেখেছে পুরো বনের মাটি। পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় এর ভূমি অমসৃণ, এবড়োখেবড়ো ও প্রস্তরাকীর্ণ। রয়েছে শত শত গর্ত ও অন্ধকার গুহা। বনের গঠনের থেকেও যে বিষয়টা শঙ্কা বা অতিপ্রাকৃতিক অনুভূতির জন্ম দেবে তা হল দম বন্ধ করা তীব্র নিস্তব্ধতা। গাছগুলো এতটাই আঁটসাঁট যে বাতাস এদের সহজে নাড়াতে পারে না। বন্যপাণীর অস্তিত্বও বিরল। একজন পরিদর্শক এই নিস্তব্ধতাকে শূন্যতার গহ্বর বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, ‘এখানে আমার নিঃশ্বাসের শব্দও মনে হচ্ছিল এক একটি গর্জন।’
৬। অধিকাংশ আত্মহত্যাকারীরা ফাঁসির পথ বেছে নেন। তাছাড়া বিষক্রিয়া ও ওষুধের ওভারডোজের মাধ্যমেও আত্মহত্যার আলামত পাওয়া যায়।
৭। ১৯৬০ সালে জাপানি লেখক সেইচো মাতাসুমোতো একটি ট্র্যাজিক উপন্যাস লিখেন যার নাম ‘কুরোয় জুকাই’। অওকিগাহারা বনে প্রেমিক যুগলের আত্মহননের মাধ্যমে সমাপ্ত হয় এই উপন্যাসের কাহিনী। ধারণা করা হয় এই রোমান্টিক চিত্রকল্পই জাপানি কালচারের উপর অশুভ প্রভাব বিস্তার করেছে। তাছাড়া ওয়াতারু তুসুরুমির ‘কমপ্লিট সুইসাইড ম্যানুয়াল’ বইটিতে বলা হয়েছে, অওকিগাহারা বনই হচ্ছে আত্মহত্যার উত্তম স্থান। কয়েকটি মৃতদেহের সঙ্গে বইটি পাওয়া গিয়েছিলো।
৮। ইউবাসিউট (Ubasute) হচ্ছে মৃত্যুর কঠোরতম একটি পদ্ধতি যার অর্থ ‘বৃদ্ধাদের পরিত্যাগ করা’। প্রাচীন কালে জাপানের অর্থনৈতিক অবস্থা সচ্ছল ছিল না। অনাহারের কষ্ট লাঘবে খাবারের মুখ কমানোর জন্য পরিবারের বয়োবৃদ্ধ সদস্যকে রেখে আসা হতো দূরে কোন পাহাড় বা বনে। যেখানে আত্মহত্যা নয়, বরং পানি ও খাবারের অভাবেই ধুঁকে ধুঁকে মারা যেত তারা। অনেকে বলে থাকেন এগুলো শুধুমাত্র লোককথা। বলা যায় জাপানের লোকসাহিত্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে এই অওকিগাহারা বন।
৯। অনেকের বিশ্বাস ইউবাসিউটে মৃত বৃদ্ধদের অতৃপ্ত আত্মা এখনো ঘুরে বেড়ায় এই বনে এবং এই আত্মাগুলো এতটাই প্রতিহিংসাপরায়ণ যে ঘুরতে আসা পর্যটকদের পথভ্রষ্ট করে দেয় ও পরবর্তীতে আত্মহত্যায় প্রলুব্ধ করে।
১০। কিছু সেচ্ছাসেবক দল এই এলাকায় সতর্ক প্রহরার ব্যবস্থা করে। বার্ষিক এই প্রয়াসের উদ্দেশ্য ছিল আত্মহত্যাকারীদের অবশিষ্টাংশ উদ্ধার করা। পুলিশ এবং স্বেচ্ছাসেবকরা মৃতদেহ উদ্ধার করে যথাযথ সমাধির ব্যবস্থা করেন। বর্তমানে জাপান সরকার উদ্ধারকৃত মৃতদেহের সংখ্যা প্রকাশ করতে নিষেধ করে। তবে প্রতি বছর ৭০ থেকে ১০০ টির মতো মৃতদেহ পাওয়া যেত।
১১। এ বনে ভ্রমণের অনুমতি থাকলেও যারা তাবু নিয়ে আসেন তাদের উপর রাখা হয় বিশেষ নজর। কেননা যারা কয়েকদিনের ক্যাম্পিং এ আসেন তাদের কেউ কেউ আত্মহত্যা নিয়ে বেশ দ্বিধান্বিত থাকেন। ভাগ্যের সাথে শেষ বোঝাপড়া করে নিতেই তাবু খাটেন এই বনে। সুইসাইড প্রিভেনশন পেট্রলের স্বেচ্ছাসেবকরা এধরণের ক্যাম্পারদের ভালোভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন, অনুনয় বিনয় করে বন ছাড়তে বাধ্য করেন। .
১২। স্বেচ্ছাসেবকরা মৃতদেহ উদ্ধারের সময় প্লাস্টিকের ফিতা বা টেপ দিয়ে রাস্তা মার্ক করে রাখেন। যাওয়ার সময় গাছে গাছে টেপ বেঁধে ভেতরে প্রবেশ করেন যেন আসার সময় রাস্তা চিনে বেরিয়ে আসতে পারেন। অন্যথায় যে কেউ পথ গুলিয়ে যাবেন এবং চিরতরে আটকা পরে যেতে পারেন বিভ্রান্তিকর এই অওকিগাহারায়।
১৩। অওকিগাহারার মাটিতে ম্যাগনেটিক আয়রনের পরিমাণ এতই বেশি যে সেলফোন সার্ভিস মোটেও কাজ করে না। জিপিএস সিস্টেম তো দূরের কথা এমনকি কম্পাসও এখানে অচল। এজন্যই টেপ বা প্লাস্টিকের ফিতা ব্যবহার করা ছাড়া অন্যকোনো উপায় নেই।
১৪। স্থানীয়রা মনে করেন এই বনটি তার মারাত্মক সম্মোহন ক্ষমতার জন্যই বিখ্যাত। এখনও পর্যটকরা পাশের মাউন্ট ফুজির সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারেন। পরিদর্শন করতে পারেন অসাদৃশ্যপূর্ণ লাভা, তিনশ বছরের পুরাতন গাছ ও মনোমুগ্ধকর নারুসাওয়া আইজ কেইভ।
১৫। ইন্টারনেট ছড়িয়ে আছে অওকিগাহারার বিভ্রান্তিকর নানা ছবি। এসব ভয়ংকর ছবি দেখার পরও যদি অভিশপ্ত এ বন থেকে একবার ঘুরে আসতে চান তাহলে আপনার জন্য একটি টিপস হল, যাওয়ার সময় অবশ্যই দিক নির্দেশনা মেনে চলবেন এবং কখনো রাস্তা ছেড়ে যাবেন না।
অতিপ্রাকৃত এই বনটির অবস্থান জাপানের ফুজি পর্বতমালার উত্তর-পশ্চিমে। গাছপালার প্রাচুর্যের জন্য কেউ বলে ‘ সি অফ ট্রিজ’ বা ‘বৃক্ষ-সাগর’। তবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ‘সুইসাইড ফরেস্ট’ বা ‘আত্মহত্যার বন’ নামে। পৃথিবীর সবচাইতে আত্মহত্যা-প্রবণ স্থানগুলোর ভেতরে এর অবস্থান দ্বিতীয়।
No comments:
Post a Comment