পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় বিষয় বোধ হয় মানুষের মন। এই মন নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। মনোবিজ্ঞানীদের করা কিছু এক্সপেরিমেন্ট তথা পরীক্ষা পাল্টে দিয়েছে মানুষের মন নিয়ে চিরন্তন ধারণা। সেরকমই কিছু পরীক্ষার কথা আজ বলবো।
A Class Divided
যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া স্টেটের স্কুল শিক্ষক জেন এলিয়ট তার শিক্ষার্থীদের উপর এই এক্সপেরিমেন্টটি চালান। মার্টিন লুথার কিংয়ের চিন্তাধারা তাকে সবসময় প্রভাবিত করত। ১৯৬৮ সালে যখন মার্টিন লুথার কিংকে খুন করা হয় তারপর থেকেই তিনি তার ছাত্র-ছাত্রীদের বর্ণবাদ, বৈষম্য এই ব্যাপারগুলো বোঝাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তা ফলপ্রসূ হচ্ছিলো না। তারা আগের মতোই মফস্বল থেকে আসা শিক্ষার্থীদের অবজ্ঞার চোখেই দেখে যাচ্ছিল।
জেন এলিয়ট তার ক্লাসে
এলিয়ট তার শিক্ষার্থীদের উপর দুইদিনব্যাপী একটি এক্সপেরিমেন্ট চালালেন। প্রথমে তিনি তার ক্লাসটিকে দুটি গ্রুপে ভাগ করলেন। প্রথম গ্রুপে রাখলেন যাদের চোখের রং নীল এবং দ্বিতীয় গ্রুপে রাখলেন যাদের চোখের রং বাদামী। প্রথম দিন তিনি প্রথম গ্রুপ অর্থাৎ যাদের চোখের রঙ নীল তাদেরকে বাদামী চোখের শিক্ষার্থীদের চেয়ে সুপিরিয়র তথা উঁচু মর্যাদার বলে ধরে নিলেন এবং বেশি সুযোগ সুবিধা দিতে শুরু করলেন। এমনকি তিনি এক গ্রুপের শিক্ষার্থীদেরকে অন্য গ্রুপের শিক্ষার্থীদের সাথে মেলামেশা করতে নিষেধ করে দিলেন। দ্বিতীয় গ্রুপের সদস্যদের আরও কোণঠাসা করার জন্য তিনি তাদের বিভিন্ন দোষ-ত্রুটি সবার সামনে বর্ণনা করতে শুরু করলেন।
এর ফলাফল হলো খুবই চমকপ্রদ। প্রথম গ্রুপের শিক্ষার্থীরা অর্থাৎ যারা নিজেদেরকে এখন সুপিরিয়র ভাবে তাদের আচরণ খুব দ্রুত পরিবর্তিত হতে লাগল। তারা ক্লাসে এখন সবচেয়ে মনোযোগী এবং কোন কিছু না বুঝলে তারা সাথে সাথে প্রশ্ন করে। ক্লাস টেস্টেও তারা দ্বিতীয় গ্রুপের সদস্যদের চেয়ে অনেক ভাল করল। সবথেকে মন খারাপ করা যে ব্যাপারটা ঘটল তা হলো, তারা তাদের দ্বিতীয় গ্রুপের বন্ধুদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করল এবং তাদের উপর এক ধরনের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করতে লাগল। অন্যদিকে দ্বিতীয় গ্রুপের শিক্ষার্থীরা হীনমন্যতায় ভুগতে লাগল এবং সবদিক থেকে পিছিয়ে পড়তে লাগল।
পরীক্ষা চলছে শিক্ষার্থীদের উপর
পরের দিন এলিয়ট একই এক্সপেরিমেন্ট চালালেন। কিন্তু এবার যাদের চোখের রঙ বাদামী তাদেরকে নীল চোখের শিক্ষার্থীদের চেয়ে সুপিরিয়র হিসেবে ধরে নিলেন। তখন ফলাফলও উল্টে গেল। অর্থাৎ নীল চোখ যাদের তারা সবকিছুতে পিছিয়ে পড়তে লাগল।
এই এক্সপেরিমেন্টটি তখনকার সময়ে খুবই আলোচিত হয়। পরীক্ষাটি করার সময়কার ভিডিওগুলো নিয়ে ২৫ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করা হয় যার নাম ‘The Eye of the Storm’। এছাড়া ‘A Class Devided’ নামে আরও একটি ডকুমেন্টারি আছে একই বিষয়ের উপর। এই এক্সপেরিমেন্টটি আমাদেরকে বোঝাতে পারে যে সমাজে যারা অবহেলিত তারা কেন পিছিয়ে পড়ে এবং নানা অপরাধের সাথে যুক্ত হয়।
Asch Conformity Study
এখন যে পরীক্ষার কথা বলব সেটির সারকথা হলো এই যে, সংখ্যাগুরুদের ভ্রান্ত বিশ্বাসও মানব মনের কাছে সঠিক মনে হয় যদিও সে জানে যে তারা ভুল।
ড. সলোমন অ্যাশ ১৯৫১ সালে এই পরীক্ষাটি করেন। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের তিনি একটি কার্ড দেখান যেখানে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের তিনটি সরলরেখা আঁকা আছে। এরপর তিনি তাদেরকে আরও একটি কার্ড দেখান যেখানে একটি সরলরেখা আঁকা ছিল। দ্বিতীয় কার্ডের সরলরেখাটির দৈর্ঘ্য পরিস্কারভাবেই প্রথম কার্ডের তিনটির যেকোনো একটির সমান এবং বাকি দুটোর দৈর্ঘ্য হয় এর থেকে বড় না হয় ছোট।
ডানের ছবির তৃতীয় রেখাটি প্রথম ছবির রেখার সমান
এরপর তিনি তাদেরকে খুব সাধারণ একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন। তা হলো, দ্বিতীয় কার্ডের সরলরেখাটি প্রথম কার্ডের কোন সরলরেখাটির মতো দেখতে? খুবই সোজা একটি প্রশ্ন এবং এখানে ১,০০০ জনকেও এই প্রশ্ন করা হলে ১০০% ক্ষেত্রে সঠিক উত্তরটি পাওয়া উচিত।
মজার ব্যাপার হচ্ছে অংশগ্রহণকারীদের একটি গ্রুপের মধ্যে মাত্র একজন বাদে বাকি সবাই ছিলেন ড. সলোমনের নিজের লোক।তাদেরকে আগে থেকেই বলা হয়েছিল ভুল উত্তর দিতে। সবশেষে যখন প্রকৃত অংশগ্রহণকারীকে একই প্রশ্ন করা হল তখন দেখা গেল সেই একজন বাকি সবার উত্তরে বিভ্রান্ত হয়ে গেল।
ড. সলোমনের পরীক্ষা
যদিও সে খুব পরিস্কার ভাবেই জানে যে কোন সরলরেখাটি সবচেয়ে বড়, তবুও সে অন্যদের ভুল উত্তরগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভুল উত্তর দিল। এই এক্সপেরিমেন্ট এটাই প্রমাণ করে, মানুষ সবসময় চায় অন্য সবার মতো হতে যদিও সে আসলে তাদের চেয়ে উৎকৃষ্ট কেউ হতে পারত।
Kitty Genovese Case
১৯৬৪ সালে নিউ ইয়র্ক শহরে নিজ অ্যাপার্টমেন্টের সামনে কিটি জেনোভেস নামের এক নারীকে প্রকাশ্যে উপুর্যুপুরি ছুরিকাঘাতের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। সেটি ছিল ওই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকাণ্ডগুলোর একটি।
কিটি জেনোভেস (সাদাকালো থেকে রঙিন করা ছবি)
কেন সেটি এত আলোচিত? কারণ The New York Times দাবি করেছিল যে, ওই সময়ে ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী ছিল প্রায় ৩৭-৩৮ জনের মতো, যাদের কেউ ওই নারীকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেনি। এরপর থেকেই এই ঘটনা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়। কেন সাধারণত জনাকীর্ণ একটি জায়গায় কেউ বিপদে পড়লে আশেপাশের কেউ সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে না? এর উত্তর বুঝতে হলে দুটি বিষয়ের সাথে পরিচিত হতে হবে। ‘Diffusion of Responsibility’ এবং ‘Bystander Effect’।
‘Diffusion of Responsibility’ এবং ‘Bystander Effect’ কীভাবে কাজ করে মানুষের মধ্যে
এমন ক্ষেত্রে সবাই ভাবে, অন্য সবাই তো আছে সাহায্য করার জন্য, আমি কেন ঝামেলায় জড়াবো নিজেকে? পরবর্তীতে গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, তুমি যত বেশি মানুষের সামনে বিপদে পড়বে তোমার সাহায্য পাবার সম্ভাবনা তত কম। কারণ তখন সবার মধ্যে কাজ করে Diffusion of Responsibility এবং Bystander Effect। আমরা একটু চারপাশে তাকালেই এই নির্মম সত্যটুকু উপলব্ধি করতে পারব। এরকম ঘটনা আমাদের চারপাশে অহরহই ঘটছে। American Psychologist পরবর্তীতে একটি গবেষণা প্রকাশ করে Kitty Genovese Case এর মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাপারগুলো নিয়ে।
Violinist at the Metro Experiment
জশুয়া বেল (Joshua Bell) একজন গ্র্যামিজয়ী ভায়োলিনবাদক। ভায়োলিনে তার বেশ কিছু বিখ্যাত সৃষ্টি আছে। তার রচিত একটি Piece (স্বরলিপি) আছে যেটিকে ধরা হয় পৃথিবীর সবথেকে জটিল এবং অপূর্ব সৃষ্টিগুলোর একটি।
জশুয়া বেল
এই এক্সপেরিমেন্টটি করার তিনদিন আগে তিনি বোস্টনের একটি থিয়েটারে বাজিয়েছিলেন, যেখানে তার ভায়োলিনের বাজনা শোনার জন্য প্রতি শ্রোতাকে সিটপ্রতি গুণতে হয়েছিল ১০০ ডলারের মতো করে।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও ওয়াশিংটন ডিসির L’Enfant Plaza মেট্রো সাবওয়ে স্টেশনে ছিল অনেক ভিড়। আর তারই মধ্যে মেট্রোর প্রবেশপথে মাথায় একটি বেজবল ক্যাপ পরে জশুয়া বেল বাজাচ্ছিলেন ভায়োলিন যা শোনার জন্য শিল্পপ্রেমীরা ১০০ ডলার খরচ করতেও পিছপা হয় না। তিনি ৪৫ মিনিটের মতো বাজিয়েছিলেন। পুরো ঘটনাটি একটি গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা হয়। যেখানে দেখা যায়, এই সময়ের মধ্যে ১,০৯৭ জন লোক তার সামনে দিয়ে চলে গিয়েছিল, যার মধ্যে মাত্র ৭ জন কিছুক্ষণের জন্য থেমেছিল তার ভায়োলিন বাজানো শুনতে এবং কেবলমাত্র একজন তাকে চিনতে পেরেছিল।
জশুয়া বেল বাজাচ্ছেন সাবওয়েতে
সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপারটি কী জানেন? এই ৪৫ মিনিটের পারফরমেন্স দিয়ে তিনি পথচারীদের কাছ থেকে আয় করতে পেরেছিলেন মাত্র ৩২.১৭ ডলার। মজার ব্যাপার হল, যে ভায়োলিনটি তিনি বাজিয়েছিলেন তার মূল্যই ছিল ৩৫ লক্ষ মার্কিন ডলার!
এই এক্সপেরিমেন্টটি করেন The Washington Post এর Gene Weingarten নামের একজন কলামিস্ট। ২০০৮ সালে তিনি পুলিৎজার পুরষ্কার পান এই সংক্রান্ত একটি ফিচার লিখে। এই পরীক্ষাটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে সাধারণ মানুষ তার চারপাশে ঘটতে থাকা ঘটনাগুলোকে কত কম গুরুত্ব দিয়ে বিচার করে।
Fantz’s Looking Chamber
একটি সদ্যোজাত শিশুর মন কীভাবে কাজ করে? তারা কীভাবে চিন্তা করে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে Robert L. Fantz ১৯৬১ সালে খুবই সহজ কিন্তু যুগান্তকারী একটি পরীক্ষা করেন সদ্যোজাত শিশুদের নিয়ে।
তিনি একটি বোর্ডে ৪টি ছবি সংযুক্ত করেন। যেগুলো এক-একটি প্যাটার্ন নির্দেশ করে। সেগুলো ছিলো Bulls-Eye(শুটিং এর জন্য ব্যবহৃত টার্গেট), প্রিন্ট করা সাদা-কালো কিছু লেখা, একটি প্যাটার্ন যেটি দেখতে দুটি চোখের মতো এবং মানুষের মুখাবয়বের একটি স্কেচ। তারপর তিনি এগুলোকে সিলিংয়ের সাথে ঝুলিয়ে দেন যাতে নিচে শুয়ে থাকা শিশুটি সহজেই এই ছবিগুলো দেখতে পারে।
শিশুটিকে নিচে শুইয়ে দিয়ে পরীক্ষক এভাবেই দেখেন সে কোন ছবির দিকে তাকাচ্ছে
এরপর তিনি লক্ষ্য করতে লাগলেন কোন ছবিটি শিশুটিকে বেশি আকৃষ্ট করে। তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে ছবিগুলো শিশুরা সাধারণত কম দেখে সেগুলোই তাদের আকৃষ্ট করবে সবচেয়ে বেশি। যেমন- Bulls-Eye।
কিন্তু বিস্ময় নিয়ে তিনি লক্ষ্য করলেন, শিশুটি অন্য সব ছবিগুলো থেকে মানুষের স্কেচটির দিকে অনেক বেশিক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে। যাদের সে সবসময়ই দেখে। পরবর্তীতে তিনি বলেন যে, শিশুরা মানুষের অবয়ব বুঝতে পারার ক্ষমতা নিয়েই জন্মায়। যারা তার দেখাশোনা করবে সেই মানুষের মতো দেখতে কোনো কিছুতেই তারা সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখাবে।
শিশুরা কেমন ছবির দিকে বেশি তাকায় তার পরিসংখ্যান
একটি মানবশিশু যেখান থেকে যেভাবে চিন্তা করে সেখান থেকেই হয়তো সব রহস্যের শুরু। পরিণত বয়সের মানুষের চিন্তা-ভাবনা এত সরল নয়, আমরা সব সময় যৌক্তিক কাজগুলো করি না।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষ এমন সব সিদ্ধান্ত নেয় যেগুলো মনে হতে পারে অকল্পনীয়। এই মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলো আমাদেরকে নিজেদের নিয়েই নতুন করে ভাবতে শেখায়।
তথ্যসূত্র
onlinepsychologydegree.info
en.wikipedia.org
apa.org
washingtonpost.com
No comments:
Post a Comment